বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
দেবস্মিতা | ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৮ : ৪৯Debosmita Mondal
শমিত ঘোষ
এমনিতে উপনির্বাচন বলে উত্তেজনা অনেকটাই কম। বাংলার বাকি পাঁচ কেন্দ্রের মতো শিল্পাঞ্চলের এই কেন্দ্রের ভোট নিয়েও তেমন মাতামাতি নেই। তিনবারের বিধায়ক পার্থ ভৌমিক ব্যারাকপুরের স্বঘোষিত 'সিংহ' কে হারিয়ে সাংসদ হয়েছেন মাস পাঁচেক আগে। স্বাভাবিকভাবেই, মফস্বল শহরে এখন কাল ভোট৷ আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক শান্ত একটা নির্বাচন। কিন্তু, রাজনীতির ছাত্র হিসেবে দেখলে নৈহাটি বিধানসভার এই উপনির্বাচন বেশ কয়েকটি কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
তার অন্যতম কারণ হলো সিপিআইএমএল (লিবারেশনে)র সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ দশক বাদে সিপিএমের আসন সমঝোতা! সিপিএমের কমরেড'রা যাকে বৃহত্তর বাম ঐক্য বলে সম্বোধন করছেন! 'বামফ্রন্ট' শব্দটায় বোধহয় লিবারেশনের নেতাদের খানিক আপত্তি আছে। অথবা লিবারেশন যে, এখনও খাতায় কলমে 'বামফ্রন্টে'র অংশ নয়, সেটা বোঝানোর খানিক তাগিদ থেকেই বোধহয় সিপিএম এবং লিবারেশনের কর্মীরা এই ঐতিহাসিক জোটকে বৃহত্তর বাম ঐক্যের নিদর্শন বলে তুলে ধরতে মরিয়া। নইলে কয়েকমাস আগের লোকসভা নির্বাচনেও নৈহাটি বিধানসভায় যে সিপিএম প্রায় ১৫ হাজার ভোট পেয়েছিলো, সেই সিপিএম, লিবারেশনকে তাদের আসন ছেড়ে দিচ্ছে, এমন ঘটনা রাজ্য রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা শেষ কবে দেখেছেন? তাও কোন লিবারেশন? না, যে লিবারেশনকে সিপিএমের কর্মী সমর্থকরা সমাজমাধ্যমে কখনো 'লেসার ইভিল', কখনও 'নো ভোট্টু' বলে ব্যঙ্গ করেছেন! কারণ, ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে লিবারেশন টানা 'নো ভোট টু বিজেপি' ক্যাম্পেইন করেছিল। এবং সিপিআইএমএল এর সর্বভারতীয় সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য তৃণমূল কংগ্রেস'কে 'লেসার ইভিল' বলে বিজেপিকে রুখে দেওয়ার ডাক দেন। বঙ্গীয় সিপিএমের কর্মী সমর্থকরা সেই থেকেই দীপঙ্কর এবং তাঁর দলের ওপর খাপ্পা! এমনকী সামাজিক মাধ্যমে দীপঙ্করকে 'মমতার দালাল' আখ্যাও দিয়েছিলেন শূন্য হয়ে যাওয়া সিপিএম কর্মী সমর্থকরা। কিন্তু গত কয়েকমাসে বিশেষত, আর.জি কর কান্ডের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। এবং এই উপনির্বাচনেই সিপিএম এবং লিবারেশনের 'জোট' নিশ্চিত হয়ে যায়। নৈহাটি আসনটি লিবারেশনকে ছেড়ে দিয়ে সিপিএম আদতে বৃহত্তর বাম ঐক্যের বার্তা দিলেন? নাকি বারবার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া আটকানোর পন্থা বার করলেন, তা ২৩ তারিখ বোঝা যাবে! আপাতত সিপিএম লিবারেশন এর এই জোট বঙ্গ রাজনীতির বিশেষত বাম রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলেই চিহ্নিত থাকবে। মহম্মদ সেলিম এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এক সঙ্গে সভা করছেন, এমন দৃশ্য কয়েকমাস আগেও বঙ্গ রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা ভাবতে পারেননি। কিন্তু, নৈহাটি বিধানসভার উপনির্বাচনের প্রচারে এমন অভাবনীয় দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে রাজনৈতিক মহল।
আবার নিন্দুকেরা বলছে, সিপিএমের কর্মী সমর্থকরা আর যাই হোক, কোনওমতেই লিবারেশনকে ভোট দেবেন না। সেক্ষেত্রে, কয়েকমাস আগের লোকসভা ভোটে সিপিএমের পাওয়া ১৫ হাজার ভোটের অনেকটাই চলে যেতে পারে বিজেপির খাতায়! নীচুতলায় বামের ভোট রামে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে এখনও অপারগ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। শেষ কয়েক বছরের স্বাভাবিক প্রবণতা, সিপিএমের মিটিং মিছিলে প্রচুর লোক হয়, কিন্তু সেই তুলনায় ভোট বাড়ে না! উলটে ভোট কমে যায়। তৃণমূলের সরাসরি অভিযোগ, নীচুতলার সিপিএমের কর্মী সমর্থকরা তৃণমূলকে আটকাতে নিজেদের ভোট বিজেপিকে দিয়ে দেয়। বস্তুত, বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেও এটা স্পষ্ট হয়, যে সিপিএমের একটা বড় অংশের ভোট পেয়েই বিজেপি আজ রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে উঠেছে। তারমধ্যেই লিবারেশনের প্রার্থী দেবজ্যোতি মজুমদার'কে সিপিএমের 'কমিটেড' ভোটাররা কতটা ভোট দেবে তা নিয়ে সিপিএম নেতৃত্বও সন্দিহান। সেক্ষেত্রে লাভবান হওয়ার কথা বিজেপি প্রার্থী রূপক মিত্রের।
৫ বছর আগে ২০১৯ এর লোকসভায় ব্যারাকপুর কেন্দ্রে অর্জুন সিং জেতার পরপর গোটা শিল্পাঞ্চলজুড়েই রমরমা ছিল বিজেপির। কিন্তু আজ সেই রামও নেই। সেই অযোধ্যাও নেই। অযোধ্যায় এখন রামলালা স্থায়ী ছাদ পেয়ে গেলেও, ব্যারাকপুরে বিজেপি'কে স্বয়ং রামলালাও আর উদ্ধার করতে পারছে না! শিল্পাঞ্চলের 'পদ্মবনে' সেই দখিনা বাতাস আজ আর নেই। মাঝে অর্জুন সিং দু'দুবার তৃণমূল -বিজেপি ঘুরে শেষমেশ আবার বিজেপিতে গিয়েছেন। লোকসভায় হেরেছেন। সংগঠনের হালও অত্যন্ত খারাপ! ২৪ এর লোকসভায় অর্জুন সিং ফের একবার বিজেপির টিকিট পাওয়ার পরে, যে বিজেপি কর্মীরা কয়েকমাস আগেও তেঁড়েফুড়ে নেমেছিলেন 'ভাইয়াজি'র হয়ে, তাঁরাও এই নির্বাচনে ম্রিয়মান। 'ভাইয়াজি' যে ব্যারাকপুরের মাটিতে হারতে পারে, এমনটা তাঁর অনুগামীরা অনেকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। তাই, বেশীরভাগ কর্মীই 'বসে গেছেন' অথবা নিষ্ক্রিয়। কেউ কেউ আবার জার্সি পালটে তৃণমূলে ফিরেছেন। কেউ কেউ ফেরার জন্য তদ্বির করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কাছে। শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে 'করে কম্মে' টিকে থাকতে হলে, ক্ষমতাসীনের সাথে থাকাটা প্রথম এবং প্রধান শর্ত!
অর্জুন সিং মাঝে মাঝে শুধু একটু চমকান! কলকাতার ময়দানে অমল দত্ত-পি কে ব্যানার্জিরা যেমন নিজের দলের ফুটবলারদের ভোকাল টনিক দিতেন তেমনই অর্জুন সিং মাঝে মাঝে টিভি' মিডিয়া ডেকে একটু লম্বা চওড়া কথা বলেন। ব্যস ওইটুকুই। শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে কার্যত এখন কোনঠাসা এককালের বাহুবলী। পার্থ ভৌমিকের কৌশলী রাজনীতির ফলে শিল্পাঞ্চলজুড়ে এখন শুধুই ঘাসফুল। ফলে বিজেপি প্রার্থী রূপক মিত্র খানিক চেষ্টা করলেও প্রচারে দাগ কাটতে পারছেন না। নৈহাটি উপনির্বাচনের প্রচারে প্রায় একাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী সনৎ দে। শহর জুড়ে দক্ষিণী নায়কদের মতো বড় বড় 'কাট আউট'! তিন তিনবারের বিধায়ক অধুনা সংসদ পার্থ ভৌমিকের জুতোয় পা গলাতে চলেছেন সনৎ। কাজটা যে কঠিন তা বিলক্ষণ জানেন তৃণমূল প্রার্থী। তাই, প্রতিটা সভায় নিয়ম করে বলছেন, "ভরত যেমন রামচন্দ্রের পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজকার্য সামলাতো, আমিও তেমনিই ভরতের মতো পার্থ ভৌমিকের দেখানো রাস্তাতেই চলব!” একেবারে তৃণমূল স্তরের সংগঠন থেকে উঠে আসা সনতের ওপরেই আস্থা রেখেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সনৎ দে'র সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল, তিনি সংগঠনকে একেবারে নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন! প্রথমে যুব সভাপতি, তারপর কাউন্সিলর, পৌরসভার স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য দপ্তরের পৌর পারিষদ সদস্য এবং ২০২১ থেকে নৈহাটি শহর তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি।
তৃণমূলের জনপ্রিয়তম স্লোগান 'খেলা হবে' কীভাবে যেন নৈহাটি উপনির্বাচনের সঙ্গে আক্ষরিক ভাবেই ওতপ্রোতভাবে মিলে মিশে গেছে! সনৎ দে'-কে ভোট দেওয়ার আবেদন চেয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন বাংলার প্রধান তিন ফুটবল ক্লাব মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের শীর্ষ কর্তা-সহ স্বয়ং আইএফএ সচিব! হঠাৎ, ফুটবল ক্লাবগুলো কেন তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে ভোট চাইলেন? তৃণমূল যুক্তি দিয়েছে, গত কয়েকবছর ধরেই ক্রীড়া প্রশাসক হিসেবে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন সনৎ দে। নৈহাটিতে বঙ্কিমাঞ্জলি স্টেডিয়ামের দায়িত্বে থাকা সনৎ দে প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছেন ক্রীড়াবিদদের! আন্তর্জাতিক মানের এই স্টেডিয়ামে এখন নিয়মিত আয়োজিত হয় কলকাতা লিগ-সহ আই লিগের ম্যাচ। যার কৃতিত্ব অনেকখানিই ক্রীড়া প্রশাসক সনৎ দে-এর। যদিও, বিরোধী দল এসব শুনতে নারাজ! শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ,বাংলার তিন প্রধান ক্লাবের আবেগকে ব্যবহার করতে চাইছে শাসক দল! তাই তিন প্রধান ক্লাবকেই 'ব্যান' করার জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে বসেছেন! পালটা এই ধরনের অদ্ভুত দাবী তোলার জন্য মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গল - মহামেডানের সমর্থকরা বিরোধী দলনেতার কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তৃণমূল প্রার্থী সনৎ দে-কে পাশে বসিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং তৃণমূল প্রার্থীকে জেতানোর আবেদন করেছেন প্রাক্তন ফুটবলার সমরেশ চৌধুরী, বিকাশ পাজি, বিদেশ বসু, মানস ভট্টাচার্যরা! কী ভাবে যেন নৈহাটি উপনির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অনেক রকম খেলা। রাজনীতির কাটাকুটি খেলার হিসেব মেলাতে চাইছে সব পক্ষই। প্রাক্তন সাংসদ বাহুবলী অর্জুন সিং যেমন চাইছেন, শিল্পাঞ্চলে নিজের পুরোনো ইমেজ ফিরিয়ে আনতে নইলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরো অতলে ডুবে যাবে! তেমনই তৃণমূল প্রার্থী সনৎ দে'ও চাইছেন প্রচারে স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসক থেকে প্রাক্তন ফুটবলারদের সামিল করিয়ে প্রচারে ঝড় তুলতে! রেকর্ড মার্জিনে জিতে প্রথমবার বিধানসভায় পা রাখতে চাইছেন তৃণমূল প্রার্থী।
সব মিলিয়ে নৈহাটির উপনির্বাচনের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেছে অনেকগুলো ঘটনা! আর এরমধ্যেই হাল্কা মেজাজে হাসছেন তিনি। সামনে শীতের মরসুমে তাঁর দু'দুটি নতুন নাটক নামছে। দলীয় প্রার্থীকে নিয়ে গোটা বিধানসভা এলাকা প্রচারের সাথে সাথে খোঁজ নিচ্ছেন নতুন নাটকের প্রস্তুতিরও। নির্বাচন নিয়ে জিজ্ঞেস করলে অনুনকরনীয় হাসি হেসে বলছেন," ভোট তো মানুষ দেবেন। দিদি যা দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটাই পালন করবো। সনৎ দে জিতবে তো বটেই। মার্জিনটা বাড়ানোই লক্ষ্য!" সবাই জানে, শুধু নৈহাটি না গোটা শিল্পাঞ্চলের রাজনীতির ভরকেন্দ্রে এখন একজনই তিনি 'হ্যালো স্যর' ওরফে পার্থ ভৌমিক।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত, লেখকের কোনও দাবি বা মতের দায় আজকাল ডট ইনের নয়)